মুক্ত বচন

মিয়ানমার সীমান্তে চীনা বেসরকারি বাহিনীর তাৎপর্য

ঋষাণ সেন

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকাজুড়ে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক দক্ষতা তার ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নতুন করে তুলে ধরছে। একদিকে অবকাঠামো, জ্বালানি ও সংযোগের কৌশলগত করিডোরগুলোর মাধ্যমে তাদের পদচিহ্ন প্রসারিত হচ্ছে, অন্যদিকে বিদেশি প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ঝুঁকিগুলোও একই তালে বেড়ে গেছে। এক সময় পারস্পরিক সুবিধা ও বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে কল্পিত হয়েছিল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)। বর্তমানে এটি ক্রমবর্ধমানভাবে ভঙ্গুরতা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সার্বভৌমত্বের দিকে এগোচ্ছে। এ ধরনের পরিবেশে চীন ক্রমবর্ধমানভাবে হাতিয়ার হিসেবে অপ্রচলিত একটি জবরদস্তিমূলক সুরক্ষাবলয় বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে।

এ পর্যন্ত তারা বিনীত ও স্থির ভূমিকায় কাজ করত। এখন তারা কেবল যৌথ উদ্যোগে সুরক্ষা দেওয়া কিংবা ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। পরিবর্তে তারা ধীরে ধীরে চীনের বহিরাগত নিরাপত্তা কৌশলের একটি নতুন স্তর হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তারা পিপলস লিবারেশন আর্মির চেয়ে কম দৃশ্যমান, কূটনীতির চেয়ে সহজেই এড়িয়ে যাওয়া যায় এবং রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপের চেয়ে তারা অনেক বেশি নমনীয়।

বাণিজ্যিক সত্তা হিসেবে চিহ্নিত এই বেসরকারি সেনাবাহিনী বেইজিংকে তাদের বিনিয়োগ রক্ষার জন্য ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে তারা সামরিক বাহিনীর সুনাম নষ্ট না করেই তাদের বিনিয়োগ রক্ষা করতে পারে। বিশেষ করে মিয়ানমারের মতো অঞ্চলে তাদের কর্মক্ষমতার পরিধি যত প্রসারিত হচ্ছে, ততই তারা কেবল বাণিজ্যিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপক বলে দাবি করাটা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।
চীনের বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ব্যবহারকে যেভাবে আলাদা করে তোলে তা হলো রাষ্ট্র এবং বাজারের মধ্যে অস্পষ্ট সীমানা। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত এই সংস্থাগুলোর অনেকগুলো সাবেক পিএলএ অফিসারদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং চীনের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। যেমন ডিউই সিকিউরিটি বা ফ্রন্টিয়ার সার্ভিসেস গ্রুপ।
বিদেশে তাদের মোতায়েনের উদ্দেশ্য কেবল উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের প্রতি বাজারের প্রতিক্রিয়া দেখা নয়। এটি একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ, যেখানে রাষ্ট্র কিছু জবরদস্তিমূলক কাজ আউটসোর্স করে এবং একই সঙ্গে ভাষ্য এবং অস্বীকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। এসব সংস্থা ধূসর অঞ্চলের মধ্যে কাজ করে–কখনও সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রীয় কিংবা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত নয়, তবে সব সময় রাজনৈতিকভাবে কার্যকর।
এই বেসরকারি সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক উপযোগিতা বেশি হতে পারে, কিন্তু ঝুঁকিও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। যখন দেশের মাটিতে নিরাপত্তা অন্য সরকারের কৌশলগত অগ্রাধিকারের জন্য দায়বদ্ধ বিদেশি শক্তির কাছে চাওয়া হয়, তখন সুরক্ষা ও হস্তক্ষেপের মধ্যে ফারাক রেখা অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। যেসব দেশ ইতোমধ্যে গৃহযুদ্ধ ও বৈধতা নিয়ে বিতর্কের মুখোমুখি, সেখানে এটি চীনাদের জড়িত থাকার ধারণা আরও জোরালোকরণ এবং চীনবিরোধী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

এই মডেলটি বেইজিংকে এমন অসম সংঘাতের দিকে টেনে নেওয়ার ঝুঁকিও তৈরি করে, যা সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একবার বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানিগুলো আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড বা সমান্তরাল সহিংসতায় জড়িত হয়ে পড়লে নিরপেক্ষ অংশীদার হিসেবে চীনের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা গ্লোবাল সাউথের সফট পাওয়ারের শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
সর্বশেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংঘাতের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততার স্বাভাবিকীকরণ একটি নজির স্থাপন করে। আজ মিয়ানমার কাল বেলুচিস্তান? পাইপলাইন, বন্দর বা রাস্তা সুরক্ষিত করার জন্য চীনা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে সরাসরি সংঘর্ষে মোতায়েন করার নজির চীনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বারা বা সার্বভৌমত্ব ক্ষয় সম্পর্কে অস্বস্তিতে থাকা আয়োজক সরকারগুলোর দ্বারা অলক্ষিত থাকবে না। যদি এখন সরাসরি সংঘাতে সক্রিয় সহায়তামূলক ভূমিকায় বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের টেনে আনা হয়, তাহলে পাকিস্তান, মধ্য এশিয়ার কিছু অংশ, এমনকি আফ্রিকান সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলেও একই রকম মোতায়েনের আশঙ্কা কেবল যুক্তিসংগতই নয়, বরং সেটি বেড়ে যাবে। অবকাঠামো সুরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতির হস্তক্ষেপের মধ্যে সীমানা দ্রুত সংকীর্ণ হয়ে আসছে। এর সঙ্গে সঙ্গে চীনের উত্থান সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ বা বাণিজ্যিকভাবে উৎসাহিত বলে দাবি করা হচ্ছে।

ঋষাণ সেন: এশিয়াজুড়ে চীনের কৌশলগত ও পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক গবেষক; ইরাবতী থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম। সূত্র: দৈনিক সমকাল

Back to top button